কুড়মি কারা? তারা কী চাইছে?
কুড়মি একটি বিশেষ সম্প্রদায়। নিজেদের সম্প্রদায় সম্বন্ধে কথা বলার সময় তারা যে বিশেষ্য পদটি ব্যবহার করে সেটি হল ‘সমাজ’। কুড়মিদের বাস মূলত ভারতবর্ষে। হাতেগোনা কিছু কুড়মি বাংলাদেশেও বসবাস করে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম জেলাসমূহ, যা একত্রে জঙ্গলমহল নামে পরিচিত, সেই জেলাগুলিতে অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বীরভূমে কুড়মিরা অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং অসমে তারা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। কুড়মিরা মূলত কৃষিজীবী। ইদানীং, চাষের থেকে আয় কমে যাওয়ায়, সমাজের কিছু মানুষ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। কুড়মিরা সাংবিধানিকভাবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ইংরেজিতে, আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস বা ওবিসি) হিসেবে স্বীকৃত। এখন কুড়মিরা ব্যাপকভাবে জনজাতি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। যদিও, এই আন্দোলনে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে বসবাসকারী কুড়মিজাতি অংশগ্রহণ করছে না।
পশ্চিমবঙ্গ ও তার সংলগ্ন রাজ্যগুলির (মূলত ঝাড়খণ্ড ও ওডিশার) কুড়মিরা নিজেদেরকে ‘ঢঁড়’ কুড়মি হিসেবে পরিচয় দেয়। ‘ঢঁড়’ মানে পেট। ‘ঢঁড়’ কুড়মি হল তারা যারা কৃষিকাজ করে ও তাদের উৎপাদিত শস্যের একটি অংশ খেরোয়াল[5] এবং হিত-মিতান (অর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ) সম্প্রদায়, যারা কুড়মিদের চাষাবাদে সাহায্য করে, তাদের মধ্যে বিতরণ করে। জনজাতি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্যে যে কুড়মিরা লড়াই করছে, তারা এও দাবি করে যে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বসবাসকারী কুড়মি জাতি এবং বাংলা, ওডিশা, ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী কুড়মি সম্প্রদায় আসলে আলাদা। নিজেদের ‘টোটেমিক’ কুড়মি হিসেবে পরিচয় দিয়ে তারা দাবি করে যে, বিহারি কুর্মি সম্প্রদায় মুর্তিপূজায় বিশ্বাসী হিন্দু হলেও কুড়মিরা আসলে সর্বপ্রাণবাদী। আসলে, কুড়মি জাতি ৮১টি গোষ্ঠী/টোটেমে বিভক্ত। গোষ্ঠীগুলির নামকরণ হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু গাছ এবং প্রাণীর নাম অবলম্বনে। যেই গোষ্ঠী যেই গাছ/প্রাণীর নামে নামাঙ্কিত সেই গোষ্ঠীর সেই গাছ/প্রাণী হল টোটেম। নিজেদের টোটেম রক্ষা করার দায়িত্ব আছে প্রতিটি গোষ্ঠীর। কুড়মিদের বিশ্বাস যে, সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারলে, প্রকৃতিতে একটা সামঞ্জস্য থাকবে। যেমন, কাঢ়ুয়ার গোষ্ঠী যাদের টোটেম কাঢ়া বা মোষ, তারা মোষ দিয়ে হালচাষ করতে পারে না; যাদের গোষ্ঠী বঁশরিয়ার তারা বাঁশগাছ কাটতে পারে না ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কুড়মি নেতারা দাবি করে যে, কুড়মিদের সর্বপ্রাণবাদী বিশ্বাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রমাণ হল তাদের গোষ্ঠীভাগ। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, এই গোষ্ঠীব্যবস্থার ওপরেও ব্রাহ্মণ্যবাদ আক্রমণ শানিয়েছে, কিন্তু কুড়মি নেতারা বিশ্বাস করে যে, তাদের সম্প্রদায় জনজাতি তালিকাভুক্ত হলে তারা তাদের এই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
আসলে কুড়মিরা স্বাধীনতার আগে প্রশাসনিক স্তরে ‘ট্রাইব’ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। যদিও, স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রশাসনের দৃষ্টিতে কুড়মির পরিচয় ক্রমান্বয়ে বদলে বদলে গেছে। ১৯০১ এবং ১৯১১ সালের আদমসুমারিতে কুড়মিদের আদিবাসী জনজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল; ১৯২১ সালের আদমসুমারিতে তারা অ্যানিমিস্ট হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল; এবং ১৯৩১ সালের আদমসুমারিতে তাদের আদিম জনজাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। কুড়মি সম্প্রদায়ের নাম ১৯৫০ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে জনজাতির তালিকা থেকে বাদ পড়ে। তার জন্য কোনও কারণ সরকারের তরফে দেখানো হয়নি। পরবর্তীতে, ১৯৫৬ সালে কালেলকার কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৯০ সালে মন্ডল কমিশন রিপোর্টের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে, কুড়মিরা (এবং কুর্মিরা) ওবিসি হিসেবে স্বীকৃত হয়।
কুড়মিরা আদৌ আদিবাসী কিনা এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। সেইসব এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। সরকারের চোখে ক্রমান্বয়ে বদলে বদলে যায় যে সম্প্রদায়ের প্রশাসনিক সত্তা, সেই বদলের ইতিহাস খুঁজে দেখলে পাওয়া যায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কিছু টুকরো টুকরো ছবি। সেই ছবিগুলো এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
Post by- অসিত মাহাত
0 Comments